শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৮ অপরাহ্ন

ভারতীয় পানি আগ্রাসন, ফারাক্কা ও তিস্তা ব্যারেজঃ বাংলাদেশের মরণ ফাঁদ

Reporter Name / ৫৯ Time View
Update : বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

ফারাক্কা ব্যারেজঃ ফারাক্কা ব্যারেজ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফুট) লম্বা যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল।

বাংলাদেশের রাজশাহী সীমান্তের ১৬.৫ কিলোমিটার উজানে গঙ্গা নদীতে এ বাধ নির্মান করা হয়। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির অজুহাতে ভারত ১৯৫৬ সালে এই প্রকল্প হাতে নেয়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে গঙ্গা প্রশ্নে জরুরি আন্তরিক আলোচনা শুরু করে। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (JRC)। ১৯৭৫ সালে ভারত বাংলাদেশকে জানায় যে, ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানাল পরীক্ষা করা তাদের প্রয়োজন। সে সময় ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ১০ দিন ফারাক্কা থেকে ৩১০-৪৫০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড গঙ্গার প্রবাহ প্রত্যাহার করার ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুমতি প্রার্থনা করে। বাংলাদেশ সরল বিশ্বাসে এতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। ভারত বাঁধ চালু করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ের পরেও একতরফাভাবে গঙ্গার গতি পরিবর্তন করতে থাকে যা ১৯৭৬ সালের পুরা শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা উন্নয়নে পলি ধুয়ে নিতে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গানদী থেকে পশ্চিমবঙ্গের ভাগিরথী-হুগলী নদীতে ১১৩০ কিউবিক মিটারের বেশি পানি পৌঁছে দেওয়া।

ভারতকে এ কাজ থেকে বিরত করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয়। ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি সর্বসম্মত বিবৃতি গৃহীত হয় যাতে অন্যান্যের মধ্যে ভারতকে সমস্যার একটি ন্যায্য ও দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরিশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন সংক্রান্ত ৩০ বছরের একটি চুক্তিতে উপনীত হতে সক্ষম হয়।

কিন্তু বাস্তবতা এই যে চুক্তি সাক্ষরিত হলেও ভারত কখনোই বাংলাদেশকে তার পানির ন্যয্য হিস্যা দেয় নাই।

ফারাক্কা ব্যারেজ বনাম বাংলাদেশের ক্ষতিঃ–
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ বাধ চালুর পর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ শুরু হয়। গঙ্গার প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে ফলে বর্ষা কালে এ দেশের উত্তরাঞ্চলে তিব্র বন্যা দেখা দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবং সৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে বিভিন্ন গুরুত্বপুরন তথ্য উঠে আসে ।

পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বললেই চলে। ইলিশ মাছ স্যাড গোত্রীয় মাছ। ০-৪২০ বিষ্ণুরেখার যেখানেই সমূদ্র সংলগ্ন নদী রয়েছে সেখানেই এই মাছ পাওয়া যায়। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ঐ ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল। ফারাক্কার আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশংকা করা হয় পদ্মা এবং তার কমান্ড অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।

তিস্তা নদীঃ
সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীটি সৃষ্টি হয়েছে। নদীটি নিলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে

১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের অতিবৃষ্টি একটি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছিল এবং সেই সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩০৯ কিমি, তার মধ্যে ১১৫ কিমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।

গজলডোবা (তিস্তা) ব্যারেজঃ ২২১ দশমিক ৫৩ মিটার দীর্ঘ, ৪৪ গেটবিশিষ্ট গজলডোবা বাধের রয়েছে ৩ টি পর্যায়। প্রথম পর্যায় সেচ প্রকল্প, দ্বিতীয় পর্যায় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তৃতীয় পর্যায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল খনন করে নৌপথ তৈরী।

সিকিম এন্ডারসন সেতুটি দার্জিলিং কালিংপং সড়কে অবস্থিত, যার ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে করনেশন সেতু। এরই ভাটিতে সিভক শহরের কাছে তিস্তা নদী ডুয়ার্সের সমতলে প্রবেশ করেছে। তারও ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে গজলডোবায় এ ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে। গজলডোবার ৭০ কিলোমিটার ভাটিতে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গজলডোবার এই বাঁধে ফটক রয়েছে ৪৪ টি, যা বন্ধ করে তিস্তার মূলপ্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে পুনর্বাহিত করা হয়। নদী বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা খালে পুনর্বাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এ বাঁধ স্থাপন করা হয়েছে। ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায়ও সেচের পানি সরবরাহ হচ্ছে। কার্যত তিস্তার পানি গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে বিহারের মেচী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে। সেখান থেকে ফারাক্কার উজানে এ পানি ফুলহার নদের মাধ্যমে পুনরায় সরবরাহ করা হবে। মেচী নদীতে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, ফলে উত্তরবঙ্গ ও বিহারে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনাও সম্পূর্ণ হবে।

জাতিসংঘের সাবেক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এসআই খান বলেন, ভারত ইতোমধ্যে এ নদীতে ৬টি বড় বাঁধ দিয়েছে। এছাড়া ছোট সেচ প্রকল্পের জন্য তিস্তার উপনদীগুলোতে দেয়া হয়েছে আরও অসংখ্য বাঁধ। জলবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে ৩০টির মতো। এছাড়া আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের হিমালয় ১নং সংযোগ খালের মানস সাংকোচ-তিস্তা গঙ্গা সংযোগ খালের কাজও সম্পন্ন করেছে ভারত। ভারত সরকার তিস্তায় গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে উজানে জলাধার থেকে পানি সরাসরি ফারাক্কা বাঁধের উজানে গঙ্গা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ভারত তিস্তা বেসিনের পানি মহানন্দা বেসিনেও সরিয়ে নিচ্ছে। গঙ্গা থেকে আরেকটি সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তার পানি দক্ষিণাত্যেও সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ভারতের রয়েছে।

তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি বনাম ১ কোটি লোকের জীবিকাঃ

তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে লালমনিরহাট জেলার ডালিয়া পয়েন্টে। এই নদী বাংলাদেশের প্রায় ১২ টি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে এসে মিলেছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং এই ১২ টি জেলার অর্থনীতি প্রত্যক্ষভাবে তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের মোট চাষযোগ্য জমির শতকরা ১৪ ভাগ তিস্তা নদীর সেচ প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ % মানুষের জীবিকা তাই এই নদীর ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। প্রায় ৬০০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি চাষের জন্য পানি প্রয়োজন ৩৫০০ কিউসেক। কিন্তু বর্তমানে তিস্তার পানি প্রবাহ ৬০০ থেকে ৭০০ কিউসেক যেখানে ১৯৮৫ সালে পশ্চিম বঙ্গের গজল দোবায় বাধ নির্মান কাজ শুরু করার আগে তিস্তার পানি প্রবাহ ছিল প্রায় ৫০০০ কিউসেক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পানি-ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন যে, ‘তিস্তার মূল প্রবাহ ভারত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তিস্তায় ডালিয়া ব্যারাজে উজান থেকে আসা পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্য। এখন যে ৬০০-৭০০ কিউসেক পানি যা আসছে তা, ধারণা করি, ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের ভাটির উপনদী থেকে’।

বাংলাদেশ অনেক দর কশাকশি করেও তিস্তা চুক্তিতে এগুতে পারে নাই। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তি চাইলেও পশ্চিম বঙ্গ সরকারের অনিচ্ছার কারনে এই চুক্তিতে এগোন যাচ্ছে না। বাংলাদেশের একটি বৃহৎ ভুখন্ড এবং সেই ভুখন্ডের বাসিন্দারা প্রত্যক্ষভাবে তিস্তা নদীর ওপর নির্ভশীল । ভারত বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিচ্ছে না। যার সরাসরি ফলাফল হিসেবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল এবং বৃহৎ জনঙ্গষ্ঠি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিচ্ছে।

তবে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি। ভৌগলিক কারনে উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টি কম হয়। তাই বৃষ্টির কারনে বন্যা হবার সম্ভাবনা কম। ভারত গজলডোবা ব্যারেজের গেট হঠাৎ করে খুলে দিলে উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। বর্ষাকালে তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার বুকে শুষ্ক মৌসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তুপ। অন্যদিকে বর্ষাকালে মুল গতিপথ বদলিয়ে তিস্তা প্রচন্ডভাবে আছরে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙ্গনে প্রতি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদী জমি হারিয়ে পথের ভিখেরী হয়। নদীর প্রবাহ পথে বিশাল চর ও উভয় তীরে ভাঙ্গনের তান্ডবে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোন কোন জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশী। কোন জায়গায় ৫০০ মিটার।

গত এক সপ্তাহ যাবৎ উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ভারত পূর্বের ন্যয় এবারেও গজলডোবার বাধ ছেড়ে দিলে এই বন্যা পরস্থিতি দেখা দেয়। বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতির কারনে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে।

এখানে বাংলাদেশের পলিসি মেকার এবং কূটনীতিকদের চরম ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের দেশের পলিসি মেকাররা এবং কূটনীতিকরা তাদের কূটনৈতিক সাফল্য দেখাতে চরম ভাবে ব্যর্থ।




আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

More News Of This Category

এক ক্লিকে বিভাগের খবর